প্রসঙ্গ- ‘ইত্যাদি’

“ইত্যাদি” দেখিনা বহু বছর হল! আগে কী বুভুক্ষের মত গিলতাম! কি সব উইটি স্কিডস, চমৎকার লোকেশনে নানারকম ক্যামেরার কারসাজিতে ধারণ করা অসাধারণ সব গান, মজার মজার গেইম ইভেন্টস… কি ছিল না! কবে থেকে দেখা বন্ধ করেছি জানিনা তবে যখন থেকে এটা হাফ্ শিক্ষামূলক হাফ্ সরকারি প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে তখন থেকেই সম্ভবত আস্তে আস্তে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।


সেদিন বাংলা নাটক দেখবো বলে ইউটিউবে ব্রাউস করছি দেখি ইত্যাদির সম্প্রতি প্রচারিত একটা পর্ব সাজেশনে দেখাচ্ছে, টাইটেল -“ইত্যাদি – মেট্রো রেইল”! বিষয়টা বুঝতে পারি নাই প্রথমে। মনে করেছিলাম পলিটিকাল সাট্যায়ার টাইপ কিছু হবে হয়ত! (কেন যে মনে করছিলাম খোদা জানে!) যাই হোক ভিডিওটা দেখা শুরু করলাম। অবশ্যই আমি অবাক হইনি এটা দেখে যে পুরো পর্বটি মূলত সরকারি “মেট্রো রেইল প্রজেক্ট” রিলেটেড একটা ডকুমেন্টারি ছাড়া কিছু না।অবশ্য তেলমারা কথা বার্তা বাদ দিলে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখে সত্যি বলতে কি বেশ চমৎকৃত হয়েছি! ইন্টেরেস্টিং লাগছিল দেখতে যে এত নিয়মতান্ত্রিক ভাবে এই বিশাল দক্ষযজ্ঞ ঢাকায় চলছে।


এই প্রচারণার মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ খুব অপ্রাসঙ্গিকভাবে জোর করে হাসানোর মত কিছু স্কিডস দেখাচ্ছিল। খুবই বিরক্তিকর অভিনয় সব পাত্র পাত্রীদের। দুই একটা বাদে সব গুলোতে উৎকট মেকাপ, বিচ্ছিরি লাইটিং আর খুবই নিম্ন মানের স্ক্রিপ্ট রীতিমত ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিল! হানিফ সংকেতের মত বুদ্ধিমান বিচক্ষণ মানুষ এসব কি প্রসব করছেন ইদানিং আমি সত্যিই জানিনা।
এবার আসি মূল কথায়। এই মুহূর্তে ঐ পর্বে প্রচারিত তিনটি নাটিকার (এগুলোকে আসলে কি বলে আমি জানিনা, বোঝানোর জন্য নাটিকা বললাম) কথা মনে পড়ছে যেগুলোর কারণে দীর্ঘকাল পর কিছু লিখতে মন চাইলো। নাটিকাগুলোতে কী অবলীলায় ভীষণ সেক্সিস্ট সব সংলাপ দিয়ে গেছে অভিনেতা অভিনেত্রিরা! আমি সংক্ষেপে এগুলোর বিষয়বস্তু নিচে বর্ণনা করছি –


নাটিকা ০১
পাত্রপক্ষ পাত্রীকে দেখতে এসেছে। পাত্রী টিকটক করে। মুখে কুৎসিত মেকাপ দিয়ে বসে আছে সপরিবারে। আদ্যিকালের মত পাত্রপক্ষ তাকে নানান প্রশ্ন করছে আর সে অত্যন্ত হাস্যকরভাবে তার উত্তর দিচ্ছে। খুবই বিরক্তিকর সংলাপ। যাইহোক পাত্রপক্ষের মুরুব্বিগোছের একজন শেষমেশ রেগে গিয়ে বললেন পাত্রীকে মুখ ধুয়ে আসতে কারণ তিনি পাত্রীর আসল চেহারা দেখতে চান। এরপর বললেন যে তিনি বুঝতে পেরেছেন যে এই মেয়ে রান্না বান্না, ঘরের কাজ কিছু জানেনা, এবং এধরনের মেয়েদের কে “থাপড়া” দেয়া উচিত! মা না, বাবা না মেয়ের ‘হলেও হতে পারে’ শ্বশুর এরকম ইন্সেন্সিটিভ মন্তব্য করছে! কেউ সেটার প্রতিবাদতো করছেইনা বরং বিষয়টাকে জাস্টিফাই করা হচ্ছে!


নাটিকা ০২
এক ব্যাক্তি তার বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছে এবং তার বন্ধু তাকে খেয়ে যেতে বলছে কারণ তার স্ত্রী এখন নিয়মিত রান্না করেন। তাদের কথোপকথনে বোঝা গেল স্বামী লোকটির চিরজীবনের অভিযোগ তার স্ত্রী রান্না করে না। আর এখন তিনি অতি সুখী কারণ ইউটিউবে রান্নার চ্যানেল খুলেছে বলে স্ত্রী এখন নানা রকম রান্না করে স্বামীকে খাওয়ান।
আচ্ছা বুঝলাম, ঠিক আছে। হাসবেন্ডের শখ হতেই পারে স্ত্রীর হাতের রান্না খেতে। তাতে দোষের কিছুনা। কিন্তু তার স্ত্রী রান্না করতে চান না এটাই তার জীবনের প্রধান “দুঃখ” আর এই দুঃখের কথা তিনি বন্ধুদের বলে বেড়ান বিষয়টা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। পর পর দুটি ভিডিওতে বিবাহযোগ্য এবং বিবাহিত মেয়েদের প্রধান যোগ্যতা/ বৈশিষ্ট্য তার শিক্ষা/ পেশা বা অন্য কিছুনা বরং শুধু রান্না করা আর বর্তমানে পুরুষদের অন্যতম মাথাব্যাথার কারণ যে মেয়েদের এই রান্নার প্রতি অনীহা- সেটাই যেন বার বার প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছিল।


(এখন হয়েছে আরেক বিপদ, এসব বিষয়ে কথা বললে “ফেমিনিস্ট” বলে গালি দেয়! হায়রে “ফেমিনিস্ট”ও একটা গালি দেয়ার মত শব্দ!)


নাটিকা ০৩
এটিই সবচেয়ে বেশি আপত্তিকর এবং আজকের পোস্টের মূল কারণ। এখানে দেখানো হয়েছে একটি ছয় সাত বছরের বাচ্চাকে নিয়ে বাবা এসেছেন ডাক্তারের কাছে। সমস্যা হল বাচ্চা কথা বলেনা বললেও বিচিত্র ভাষায় বলে যা কেউ বোঝেনা। ডাক্তার অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তার সমস্যার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেন যে, যেহেতু মা বাচ্চাকে সময় দেয় না, বাচ্চার সাথে গল্প করেনা, বাচ্চা বুয়ার কাছে মানুষ হয়, আর নানান ভাষায় বানানো কার্টুন দেখে তাই এই রকম বিচিত্র ভাষায় কথা বলে। এটা কোন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য আমার জানতে ইচ্ছা করছে। কারণ একজন ডাক্তারের মুখ নিঃসৃত সংলাপ এগুলো! আরও দেখা যায় ডাক্তারের চেম্বারে পেছনে বসা মুরুব্বিটাইপ আরেকজন অযাচিতভাবে এই আলাপে ঢুকে নানান রকম বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন যে কেন এযুগের বাচ্চারা এমন এবং স্পেসিফিক্যালি বলেন আগে বাচ্চারা “মা, নানি, দাদি, চাচি, খালা এদের কাছ থেকে কথা শিখতো এখন বাচ্চাদের মায়েরা বাচ্চাদের কে বুয়ার কাছে দিয়ে রাখে”!!!


লক্ষ্য করুন কোথাও বাবার বা কোন পুরুষ আত্মীয়ের ভূমিকার কথা উল্লেখ নাই!! সামাজিক সমস্যা হাইলাইট করতে হলে এখানে অতিরিক্ত ডিভাইস দেখার বিষয়টি সামনে আসতে পারতো বা একটা বাচ্চার আরেকটা বাচ্চার সাথে ফিসিক্যালি খেলাধুলা করার সুযোগের অভাব বিষয়টি সামনে আসতে পারতো।


ইত্যাদির মত দীর্ঘদিনের জনপ্রিয় একটা অনুষ্ঠানে এধরণের স্টেরিওটাইপ বস্তাপচা পুরনো ধ্যান ধারণা প্রমোট করছে! মা’দের বাইরে কাজ করা মেয়েদের রান্না করা না করার মত জেন্ডার স্পেসিফিক ট্র্যাডিশনাল রোল থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়গুলো সমস্যা হিসাবে সামনে নিয়ে আসছে??


আমি একজন চাকরিজীবি মায়ের সন্তান। আমার সাথে বসে বসে সারাদিন গল্প করার সময় আমার মায়ের ছিলনা। আমরাও জীবনের প্রয়োজনে গৃহকর্মীদের সাথেই বেশি সময় কাটিয়েছি। আর আমাদের ছোটবেলাও কেটেছে ‘টম এন্ড জেরি’ কিংবা ইংরেজি সব সিরিয়াল দেখে কারণ বাংলায় তখন বাচ্চাদের জন্য তেমন কোন কনটেন্ট ছিলনা। তখনো অনেক বাচ্চা ছিল যারা ‘নন-ভারবাল’ বা ‘ডিলেইড স্পিচ’। তার আগেও ছিল। যেসব মা’রা বাচ্চাদের অনেক সময় দিতে পারেন তাদের সন্তানেরও এ সমস্যা হতে পারে যারা পারেন না তাদের সন্তানদেরও হতে পারে। এটা যতটা না সোশ্যাল ইস্যু, তার চেয়ে অনেক বেশি মেডিক্যাল ইস্যু। একইসাথে ভীষণ সেনসিটিভ ইস্যুতে বটেই। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি একে একেকটা মা ধনী/ গরীব/পেশাজীবি/হোম মেকার নির্বিশেষে বাচ্চার এধরণের সমস্যায় কী অমানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যান এবং রাতদিন এক করে পরিশ্রম করেন । সুতরাং এরকম জাজমেন্টাল অবৈজ্ঞানিক মতামত একজন ডাক্তারের চরিত্রের মুখ থেকে বলানোর আগে এবং তা জাতীয় মাধ্যমে প্রচার করার আগে হাজারবার চিন্তা করা উচিত। (আবার প্রমোতে দেখলাম ‘শিক্ষামূলক ও বিনোদনধর্মী’ অনুষ্ঠান লেখা!! “শিক্ষামূলক” সিরিয়াসলি!!??)


আর কোন্ মা না চায় যে বাচ্চার সাথে বেশি সময় কাটাতে? কিন্তু কয়টা মধ্যবিত্ত পরিবারে বর্তমানে সেই লাক্সারি আছে যে বাবার একার ইনকামে সংসারের খরচ সহজে বহন করতে পারে! বাস্তবতার চাপে পড়ে হোক, সংসারের আয়ের দায়িত্ব শেয়ার করার জন্য হোক , একটা সম্মানজনক জীবনমান বজায় রাখার জন্য হোক বা নিজের ক্যারিয়ার গড়ার জন্যই হোক- একজন মা শিশু সন্তানের দায়িত্ব আরেকজনের উপরে দিয়ে বাইরে কাজ করেন। এটা আমি আপনি জাজ করার কে? আর সন্তান লালন তো শুধু মা’র একার দায়িত্ব না।


সন্তানের যেকোন সমস্যা হলে মা’র ঘাড়ে দোষ দেয়া অনেক পুরনো কালচার। ইত্যাদি আসলেই পুরনো দিনের বাতিল জিনিস হয়ে গেছে। ডাক্তারের চেম্বারে বসা সেই বাচাল বয়স্ক লোকটির চেয়েও অশীতিপর এটা।


ইত্যাদি নাকি “সমাজের ছোট বোড় অসংগতি” তুলে ধরে! আমিতো সরকারের সফলতা আর এযুগের মেয়েদের/মা’দের ইমেইজকে বিকৃতভাবে তুলে ধরা ছাড়া এতে আর কিছুই পেলাম না!!!


আর আমি এতদিনে থিমসংটার আইরনি ধরতে পারলাম, এটা আসলে ইত্যাদি অনুষ্ঠানকে উদ্দেশ্য করে না বরং এর একুশে পদক প্রাপ্ত নির্মাতাকে নিয়েই লেখা
“কেউ কেউ অবিরাম চুপি চুপি
চেহারাটা পাল্টে সাজে বহুরূপী
বোঝাতো যায় না তাদের মতিগতি… “

About the Author:

Developer Herwill

Developer Herwill