মনে রাখবেন মন খুলে বাঁচার অধিকার সবার আছে- হ্যাঁ আপনারো আছে।

সৌভাগ্য বসত সিডনিতে এক পেরেন্টিং গ্রুপে কয়েক সপ্তাহের জন্য বাংলা অনুবাদ করে দেবার কাজ করেছিলাম। সেখানে বেশ কিছু আপুর সঙ্গে পরিচয়… ব্যক্তিগত ভাবে না তবে প্রফেশনাল দুরত্ত বজায় রেখে যতটুকু চেনা যায় আর কি। পেরেন্টিং গ্রুপে মা রা বিভিন্ন সমস্যা’র কথা তুলে ধরে এই ধরুন কেও কেও বাচ্চা কে জিদ করলে পাত্তা দেন না, অনেকে বাচ্চাকে বোঝায়, অনেকে বকা দেন। যেহেতু গ্রুপে সবাই নিজের ঘরের কথা একে অপরের সামনে বলছেন এবং সব ব্যক্তিগত তথ্য আদান প্রদান হচ্ছে… যেমন কেন তাদের রাগ লাগে যখন তাদের কষ্টের কাজগুলো বৃথা হয়ে যায় যখন বাচ্চার বাবারা বাচ্চা জিদ করলেই যা বায়না ধরেছে তা সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেয়, কিংবা কারো বর উল্টো বাচ্চাকে শাসন করলে মাকেই বকে যে ও তো বাচ্চা ও কি বোঝে? এই গ্রুপটিতে সবাইকে বলা হয়েছিল নির্দ্ধিধায় একে অপরকে বিশ্বাস করে কথাগুলি সেয়ার করতে কারন গ্রুপে যা বলা হবে সেটা কেও গ্রুপের বাইরে বলবে না কিংবা কারো পিঠ পিছে তাদের এই ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলে আলোচনা করা ও কুৎসা রটাবে না।
গ্রুপে থেকে বেশ কিছু জিনিস জানার সুযোগ হয়েছিল।


প্রথমত: বাঙ্গালী মহিলারা সহজে একে অপর কে বিশ্বাস করতে পারে না। এর পিছনে কারন আছে… মিডিয়া’র মাধ্যমে নাটক সিরিয়াল দেখে মেয়েরা ধরে নেয় বাকি মহিলারা খালি অন্যের সুখে ঈর্ষান্বিত। যদিও এটা সব সময় সত্যি নয় কন্তু এই চিন্তা আরো নিশ্চিত করার জন্য ভাবি সমাজ কিংবা মা, আন্টিদের যখন ছোট থেকে মেয়েরা পিঠ পিছে পরনিন্দা করতে শোনে তখন অবিশ্বাস মনের মধ্যে সুন্দর একটা যায়গা করে নেয়।


আরেকটা কারন যেটা গ্রুপের মাধ্যমে জানতে পারলাম তা হলো সবার বর তাদের স্পাউস করে নিয়ে এসে বাসার বাইরে অনুমতি ছাড়া এক পাও যেতে দেন না। এসব বরেরাই যেসব বন্ধু ও বন্ধু পত্নীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে তারা খুব কুটিল মনের। কোন আপু ভুলেও যদি মনের কষ্টের কথা সেয়ার করে থাকে সঙ্গে সঙ্গে এসব ভাবি উদ্যোগ নিয়ে আপুর বরকে বলে দিয়েছে কিংবা অন্য ভাবিদের বলে বরং আপুটাকে নাস্তানাবুদ করেছে। এর ফলে ওই আপু আর সাহস করে নি যে সে কাওকে তার মনের কথা বলবে।


চিন্তা করুন নতুন দেশ, আত্মীয় পরিবার ফেলে মনের কথা বলার মানুষ তো নেই তার ওপর দেশে ফোন দিয়ে এসব কাওকে বললে উল্টো পরিবারকে দুশ্চিন্তায় ফেলা হবে ভেবে বছর কে বছর মনের এসব চাপা কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকা কতটা কঠিন … কতটা কষ্টের।


দ্বিতীয়ত: আপুরা সবাই অবাক হলেন যখন জানতে পারলেন আমি আমার পরিবারের সাথে অল্প বয়সে অস্ট্রেলিয়া এসেছি এবং আমার তখন বরকে (Ex)আমি বিয়ে করে এখানে এনেছি, উপর্যুপরি সে ছিল ঘর জামাই। হঠাৎ করে আমি আকর্ষণপূর্ণ একজন হয়ে উঠলাম। সবাই খুব করে চেপে ধরলো মুদ্রার অন্য দিক না জানি কত সুন্দর সেটা জানার জন্য।


সত্যি বলতে অনেক সুন্দর। আমাকে দমিয়ে রাখার, নিয়ন্ত্রণ করার কেও নেই। করতে চাইলেও আমার পরিবার আমার পাশেই আছে এটা অনেক বড় শক্তি। আমাকে অনুমতি নিয়ে চলতে ফিরতে হয় না। আমি স্বাবলম্বী কারন এদেশে আমার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, চাকরি সবকিছু। মন খারাপ হলে বন্ধু আছে যাদের মনের কথা বলতে পারি ওরা বিশ্বাসঘাতকতা করে না, চাইলেই যেখানে খুশি গেলাম, মন মতন খরচ করলাম, যা মনচায় কিনে খেলাম, পড়লাম। কারো বলে দেওয়া পথে আমাকে চলতে হয় না এটা আপুদের কাছে খুব বড় একটা ব্যাপার ছিলো। অনেকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমার কথাগুলি শুনছিলেন যেন আমি রুপকথা শোনাচ্ছিলাম ওনাদেরকে। আমি আমার কথাগুলি গর্ব করে বলিনি, বরং যা সত্যি সেটাই বলেছিলাম যেমনটা আজও বলছি।
যা আমি লিখলাম সেসব প্রতিটি মানুষের ন্যায্য অধিকার। সবার অধিকার থাকা উচিত মন খুলে মনের কথা বলার বন্ধু/শুভাকাঙ্খি থাকা, ইচ্ছে হলে খরচ করতে পারার, নিজের মতন নিজের বাচ্চা মানুষ করার, যা ইচ্ছা করলো তা কিনে খাওয়া…পড়া, লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া, চাকরি করার, আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার। সবার অধিকার আছে প্রতি পদে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারার, ভালো না লাগলে সেটা বলতে পারার, অন্যায় প্রতিবাদ করার। অধিকার আছে মুখ বুজে সহ্য না করে সাহায্য চাইবার। নিজের বান্ধবী নিজে বেঁছে নেওয়ার, আটকে না থেকে এগিয়ে যাওয়ার।


আমি জানি privileged থেকে এসব কিছু বলা খুব সহজ কিন্তু এইসব privilege গুলি আপনার হতে পারে এই বিশ্বাস আপনাকে রাখতে হবে। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, অবলা নারী হবার জন্য আপনার জন্ম হয় নি। হাজার কষ্টের মধ্যে বাঁচার মতন প্রান শক্তি, প্রচন্ড প্রসব বেদনা, লাঞ্ছনা, একাকিত্ব সহ্য করতে পারলে উন্মুক্ত নিয়ন্ত্রণহীন পরাধীনতার জীবন ত্যাগ করা আরো সহজ হবার কথা। আমি বলছি না সবাই তাদের বরকে ছেড়ে দিন! দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি বলছি আপনার অধিকার নিয়ে সচেতন হন। অধিকার আদায়ের পথে পদক্ষেপ নিন। নিজেকে না জানার থেকে বের করে আনুন, জানুন, জানার, শেখার, বোঝার আগ্রহ রাখুন। কথা বলুন, বিশ্বাস করতে পারার মতন বন্ধু বানান। নিজেকে অসহায়, অপারগ নয় স্বাধীন, আত্মবিশ্বাসী করে তুলুন। বরের সঙ্গে কথা বলুন, আপনি আপনার অধিকার নিয়ে সচেতন এটা জানান, আপনি নিজেকে অস্ট্রেলিয়ায় যেকোন পরিবেশে মানানোর জন্য উপযুক্ত করতে চান সেই ইচ্ছা প্রকাশ করুন। গাড়ী চালাতে শিখতে চান, ঘরের বাজেট করুন, সঞ্চয় করুন, ছোট কোর্সে ভর্তি হন…


নতুন বন্ধু বানাতে বাচ্চাদের প্লে গ্রুপ, লাইব্রেরি অনেক সাহায্য করে। দেশি কাওকে বিশ্বাস করতে দ্বিধা হতেই পারে যেহেতু একই জাতির মানুষ ঘরের কথা বাইরে রটালে পুরো সমাজে কোনঠাসা হওয়া সম্ভব। তাই বিদেশি কাওকে বন্ধু বানান, নতুবা প্রতিবেশি দেশের প্রবাসী মহিলাদের সঙ্গে আলাপ করুন। দেখবেন যত বেশি মানুষের সঙ্গে মিশবেন তত বেশি জানার পরিধি বাড়বে। এটাও সম্ভব আপনি আপনার মতন সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কিংবা গেছে এমন অনেক কে খুঁজে পাবেন। আরেক ভাবে তথ্য সংগ্রহ করা যায় তবে তার জন্য ইন্টারনেট ব্যাবহার জানা প্রয়োজন। গুগল সার্চে যা জানতে চান তা খোঁজ করুন দেখবেন শত শত প্রশ্নের উত্তর পাবেন, সমস্যার সমাধান পাবেন। তবে সব নিজে নিজে পারতে হবে এমন কথা নেই দরকার হলে কাউন্সেলিং করুন… এতে মনের কথা আপনি এমন একজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারবেন যে কিনা একজন তৃতীয় ব্যক্তি সে আপনাকে নিরপেক্ষ মতামত নেবার জন্য সাহায্য করতে পারবে। আমরা জাতিগতভাবে ঘরের কথা পর কে বলা যাবে না নিজের সমস্যা নিজেই সামলাও এসব এ বিশ্বাস করি কিন্তু বিদেশে যখন পরই একমাত্র ভরসা তখন এই চিন্তা থেকে বেড়িয়ে আশা শ্রেয়।
আপুদের উদ্দেশ্যে লিখছি জানি না কেও এই লেখায় উপকৃত হবেন কিনা। বিদেশে এসে প্রথম যা করবেন তা হলো ইংরেজি শিখবেন, ভাষার কারনে অনেকে পরনির্ভরশীল হতে বাধ্য থাকেন, যদি নিজেকে প্রকাশ করার মতন ভাষা থাকে, সাহস থাকে কেও আটকাতে পারবে না। বাংলা অনুবাদ করে দেবার অনেকে রয়েছে তাই ইংলিশ বলতে না পারলেও নিরুৎসাহিত হবেন না। আপনার অধিকার সম্পর্কে জানুন সেগুলি আপনাকে ন্যায্য ভাবে দেওয়া না হলে প্রতিবাদ করুন, সাহায্য চান। বন্ধু নেই, শুভাকাঙ্খী নেই তাতে কি, নিজে নিজের বন্ধু হন, নিজের ভালো নিজেকে চাইতে হবে। সব অন্যায় মাথা পেতে নিতে হবে এই ধারনার বাইরে বের হবার চেষ্টা করুন। দেশ পরিবর্তন করতে পেরেছেন, পরিবার ছাড়া বিদেশে আসতে পেরেছেন তাহলে নতুন ভাবে ভাবতেও পারবেন। যা ছোট থেকে শিখেছি তাই সঠিক কে বলেছে? মুখ বুজে সহ্য করা হয়তো সহজ, হয়তো অনেক কারনে চাইলেও বাচ্চার মুখ দেখে, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, আর্থিক স্থিতিশীলতা থাকবে না এসব আপনাকে ভাবাচ্ছে… কিন্তু এখানে অনেক সুবিধা আছে আপনি সাহায্য পাবেন কিন্তু চাইতে হবে। লজ্জার মাথা খেয়ে যদি দিনের পর দিন নিজের আত্মসম্মানের গলা টিপে অন্যায় সহ্য করতে পারেন, নির্লজ্জ হয়ে সাহায্য ও চাইতে পারবেন। মনে রাখবেন মন খুলে বাঁচার অধিকার সবার আছে… হ্যাঁ আপনারো আছে।

About the Author:

Developer Herwill

Developer Herwill