পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন যোগাযোগ মাধ্যম চিঠি।
আজ বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমের কাছে এই চিঠি বিষয়টি আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি।
কয়েকজন বন্ধু মিলে আমরা কিছু কাল্পনিক চিঠি লিখেছিলাম।
তারই একটি এখানে…..
প্রিয় আমার,
ঘুম ভেঙে গেলো খুব ভোরে।
জানালার কবাটের ফাক দিয়ে সরু ফিতের মতো আলো ঘরে এসে ঢুকছে মাত্র,তাতে অদৃশ্য ভাসমান কনারা,একটু পরেই তারা রোদ হয়ে হেসে উঠবে।এই নরম রোদের হাসি প্রতিদিন আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যায়।
এই ভোর বেলাতেই তোমার প্রাণ ভীষণ চা চা করে উঠতো।
গা ধুয়ে সবুজ শাড়ীটা পরে নিয়েছিলাম আরও আগে। শ্লথ হয়ে আসা হাতে তুলে নিলাম কলম, অনেক বছর পরে।
জানো বারান্দায় কী কুড়িয়ে পেয়েছি? ঝরা বেলি ফুল।আজ আমাদের ত্রিশ বছরের বিবাহ বার্ষিকীতে মালার বদলে সেই ঝরা ফুলটিকেই গেঁথে নিলাম চুলে।
এ কী তোমার উপহার নাকি বিধাতার উপহাস কে জানে?
একবার চেনা হয়ে গেলেই প্রথমবারের অচেনা, রোমাঞ্চকর অনুভূতি নাকি উধাও হয়ে যায়।
কিন্তু এই ত্রিশ বছরে, আমাদের কোনো অনুভব উধাও হয়েছিলো না আমরাই তাদের বিসর্জন দিয়েছিলাম তা আজ বারবার ভাবি।
কিছুদিন আগেই আমার চোখের ছানি কাটানো হোলো।তুতুনকে স্কুলে আনা নেয়ার বড্ডো অসুবিধে হচ্ছিলো যে। সেই স্পষ্ট দৃষ্টির উপর নানান রঙ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে বারবার।
সেই যে প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে থাকা অষ্টাদশী মেয়েটি।ছুটতে ছুটতে এসে লাজুক হাসি দেয়া তুমি, হাতে লুকিয়ে রাখা বেলি ফুলের মালা।
অন্তরালে সূর্য, পাশে সজল নীলাভ মেঘ…….
কিছুটা আবিষ্ট, কিছুটা সম্মোহিত দুজন মানুষ।
সবসময়ই কথার দায় আমার আর মগ্ন শ্রোতা তুমিই হতে।
আর আজ দেখো আমার কথা শুনবার কেউ নেই।
সংসার শুরু করবার পরে দায়িত্ব, কর্তব্য আর কাজের ভীড়ে, সেই বেলি হাতে আর মালা চুলে ছেলেমেয়ে দুটো কোথায় যে হারিয়ে গেলাম।
আমরা হয়ে গেলাম দুটো মেশিন।
সন্তানদের খুব বেশী ভালোবাসলাম, অনেক স্বাধীনতা দিলাম আর কেমন করে যেন ওদের কাছে বোঝা হয়ে গেলাম। এ এক অদ্ভুত ম্যাজিক, নাকি ধাঁধা আজও বুঝতে পারি না।
তাই আজ ত্রিশ বছরের বিশেষ দিনটিতে, তোমাকে শুভেচ্ছা জানাতে আশ্রমের ঠিকানাই আমার সম্বল আর দেখা করবার জন্য ছেলের অনুগ্রহ আর মেয়ের দয়ামিশ্রিত মূল্যবান সময়ের প্রত্যাশা।
প্রতিদিনের মোবাইলে যে ঘেরাটোপের কথা তা কী এই ত্রিশ বছরকে ধরতে পারে? বারবার মনে পড়ছে সেই দিনগুলো।
সন্তানদের যত্নে,ভালোবাসায় উজাড় করে দেয়া আমাদের সুখী মুখগুলো। সম্মোহিত ছিলাম আমরা ভালবাসার চারাগুলো নিয়ে।
সেই সম্মোহন, ভিতরের মেঘগুলোকে কখনোই অগ্নিবর্ষী হতে দেয় নি। ভালোবাসার সম্মোহন।
তবু আজ স্ফুলিঙ্গ জাগে হৃদয়ে। নিজেদের উজাড় করে দেয়া সেই সময়গুলো, সেই তুমুল বৃষ্টি,কোল ভরা শিউলি ফুল,শুকনো বকুল মালা…….ভীষন অশ্রান্ত, অভ্রান্ত।
আজ বেলাশেষে তাই কী দুজন দুদিকে??
কী ভীষণ বোকা ছিলাম আমরা,ভেবেছিলাম পুতুল মানুষ করছি।
আজ অবাক হয়ে দেখি, আমরাই পুতুল আর সুতোগুলো আমাদের ছেলেমেয়েদের হাতে।
সেই সুতোর টানে দুজন ছিটকে গেছি দুদিকে।
সময়টা যদি ফিরিয়ে আনতে পারতাম। সেই ছেলেভুলানো কাজ গুলো সরিয়ে, শুধু তোমার পাশে গিয়ে বসতাম। এতো কথা কিছুতেই জমতে দিতাম না।
ছানি কাটার পরে আমার চোখে খুব সহজেই পানি আসে আজকাল।
কখনো কী ভেবেছিলাম, ত্রিশ বছর পরে আমার তোমাকে এভাবে লিখতে হবে।
কেনো ভাবিনি, সেই হিসাবটাই বারেবারে মেলাতে যাই।
তুমি ঠিকমতো অষুধ খেও। রাত জেগো না।
আমিও জাগি না। এখন একা ঘরে ঘুমাতেও আমার আর ভয় হয় না, জানো!!
শেষ করছি, একটু পরে তুতুনকে নিয়ে স্কুলে যাবো।
ভালো থেকো।
ইতি,
তোমার বকুল সখী।