মাঝেমাঝে জীবন নামে ধাঁধার উত্তর খুঁজতে অতীতে ডুব দিতে হয়।
তেমনি এক উতসুক বিকেলে,
চোখ পড়লো আমার কন্যার উপরে। চোখ আসলে সবসময়ই ওকেই খোঁজে, শুধু চোখ কেন, এই পুরো জীবনটাই যে ওর জন্য তা জগতসুদ্ধ সবাই জানে।
সেই মেঘলা বিকেলের কথামালাঃ
মেয়েঃ মা, আজকে তোমার জীবনের গল্প বলো না।
আমিঃজীবিনের গল্প আবার কী রে?
মেয়েঃ এই তুমি কেমন ছিলে আমার বয়সে,ন্যাগিং নাকি সুইট? নার্ড নাকি দুষ্টু, এসব আর কি।
আমিঃএইসব ভাষাই আমরা জানতাম না।
মেয়েঃ আহা, এখন তো জানো,বলো না তুমি কী প্রতিদিন স্কুলে যেতে?
আমিঃ হ্যা, আমরা প্রতিদিন স্কুলে যেতাম।তবে শুধু পড়াশুনোর জন্য না।
মেয়েঃ তাহলে??
আমিঃ আমরা তো বিশাল দল মিলে স্কুলে যেতাম।আমাদের বাসায় আসতো যুথী,তারপরে আমরা যেতাম রিমার বাসায়,পথে দেখা হয়ে যেতো রুনু, মুনা,ফারজানা,কেয়া, বেবি আরও অনেকের সাথে।তারপরে দলবেঁধে গল্প, হাসি আর স্কুলে যাওয়া।
মেয়েঃ তোমার সাথে নানু যেতো না?
আমিঃ না মা।
মেয়েঃ তাহলে আমার কেন স্বাধীনতা নেই?
(আমি চুপ করে থাকি)
মেয়েঃআচ্ছা, থাক, সমস্যা নেই। তুমি আমার সাথে যাও আমার ভালোই লাগে।
শুধু ছুটির সময় একটু দেরি করে যাবা।
তুমি সবার আগে যাও আমার একটুও ভালো লাগে না।
আমিঃ তাড়াতাড়ি বের হলে জ্যামে পড়া লাগে না, বাসায় গিয়ে সময় পাওয়া যায়, আমার একটু সুবিধা হয়।
মেয়েঃ তোমার এসব নিয়ম একটুও ভালো লাগে না মা।ওই ছুটির সময়টাই তো আমরা একটু গল্প করি।তোমাকে সব টিচার চেনে, দূর থেকে দেখলেই আমাকে বলতে থাকে, “যাও সোনু মা এসেছে”।আর গল্প করা যায় না।
তুমি একা স্কুলে যেতে, আসতে আর আমাকে
এটুকুও দিবে না?
আমিঃআচ্ছা ঠিক আছে মা। শুধু বৃহস্পতিবার আগে যাবো, গানের ক্লাস আছা না!
মেয়েঃ উফ, এটা আমার আরও অসহ্য লাগে। তুমি কী গানের স্কুলে যেতে?
আমিঃ হুম যেতাম তো।
মেয়েঃ প্রতিদিন?
আমিঃআরে, না প্রায়ই যাওয়া হোতো না।নিয়ে যাবার মানুষ থাকতো না।
আর তোমার নানু এতো আগ্রহী ছিলো না।
মেয়েঃ তাহলে তুমি কেন এমন করো,আমার তো আগ্রহ নেই মা।
আমিঃ এখন বুঝতে পারছো না, বড়ো হলে দেখবে কতো ভালো লাগে।
এই যে আমি শিখতে পারলাম না মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়।
আমার কতো স্বপ্ন ছিলো।
মেয়েঃ তোমার স্বপ্ন আমার উপর চাপালে হবে না মা। আমার স্বপ্নটা আমি দেখবো প্লিজ।
আমিঃএটা কী চাপানো হলো,তোমার এতো সুন্দর কণ্ঠ, গান না শিখলে পরে বড়ো হলে বলবা “মা শিখালো না”।মেয়েঃকখনোই বলবো না প্রমিজ।
আমিঃথাক, প্রমিজ করা লাগবে না, তোমাকে আমি গানের স্কুলে নিয়ে যাবোই।
মায়েঃ জানি, আমার কোনো স্বাধীনতাই নেই।
আমিঃআহারে আমার বাচ্চাটা।
মেয়েঃশুধু এভাবে বাচ্চা বোলোনা তো,ভালো লাগে না। আমি এখন টিন এজার।
আমিঃআমার কাছে সারাজীবন বাচ্চাই থাকবা।
মেয়েঃ এটা কোনো কথা হোলো?
আচ্ছা বলো না স্কুলে থাকতে তোমার কয়টা ক্রাশ ছিলো?
আমিঃ কয়টা মানে?
মেয়েঃআরে, আমাদের স্কুলে তো একজনের অনেক ক্রাশ থাকে।আবার একজন ছেলেকেও দুই জন পছন্দ করে।
ফ্রেন্ড হলে কোনো সমস্যা নেই।কেউ জেলাস হয় না।
আমিঃবলো কী?
মেয়েঃ তুমি আবার মিলু খালামনিদের সাথে এসব গল্প কোরো না।
আমিঃ না, না বলবো না। তোমার কোনো ক্রাশ আছে মা?
মেয়েঃ(লজ্জিত হাসি দিয়ে) আরে না মা ছোট বেলায় ছিলো, কিন্তু এখন নেই।
আমিঃএখন নেই কেন?
মেয়েঃ কী জানি, আমার নেই, তাসফিয়ার, তনুর নেই।শেহরীনটার তো হাজার হাজার ক্রাশ। (আবার হাসি)
তোমার স্কুলে কোনো ক্রাশ ছিলো?
আমিঃ আমরা তো মেয়েদের স্কুলে যেতাম।
মেয়েঃওহো, তাহলে তোমাদের সাথে শেহরীন,নুমাইরার মতো মেয়েগুলোর বেশ দুঃখ ছিলো।
আমি জানি তুমি নার্ড ছিলা।
আমিঃকি জানি কী ছিলাম।তবে আমরা আমাদের মায়েদের সাথে এতো কথা বলতাম না।
মেয়েঃ কই নানুতো কঞ্জার্ভেটিভ না, আমার সাথে তার জীবনের কতো গল্প বলে।
আমিঃ কী গল্প?
মেয়েঃ সেগুলো সিক্রেট।
আমিঃ আমার নানুও আমাকে তার জীবনের গল্প বলতো।
মেয়েঃ তুমি তোমার নানুকে ভুলে গিয়েছ মা।
আমিঃ হুম, আমি খুব সেলফিস রে।
মেয়েঃ (আমার হাত ধরে) মোটেও তুমি সেলফিস না।
আচ্ছা, তুমি বলো সেলফিস হওয়া ভালো না আবার নিজেকে সেলফিস বলছো। আমি মাঝে মাঝে তোমাদের কথা বুঝি না।
আমিঃ সত্যিকারের সেলফিস হলে তাকে কেউ পছন্দ করে না।আর পৃথিবীতে কেউই পুরোটা খারাপ না।
মেয়েঃ উফ, আবার কঠিন কথা, শোনো আমি দুটো নেইল পলিশ আর একটা বই অর্ডার করেছি।কালকে আসবে।
তোমার কোনো বই লাগবে?
আমিঃ না মা, আগের বই এখনো আছে, শেষ করে নেই।
মেয়েঃআর তোমার লেখা? তোমাদের “লেখক বন্ধুরা” গ্রুপের লেখাটা লিখবে না?
লুনা খালামনি দেখলাম তোমাকে একটা আইডিয়া দিয়েছে(মিটমিটে হাসি)
আমিঃ তুমি পড়েছ কেন?
মেয়েঃ আহা পড়তে চাই নি তো,নোটিফিকেশন আসলো আর দেখে ফেললাম।
এভাবে কথা চলতে থাকে,জীবনের পথ ধরে।প্রকৃতি তার বেহাত হয়ে যাওয়া সম্পদের মতো আমাদের সময় গুলোকেও ঠিক কুড়িয়ে নিতে চায়, জমিয়ে রাখবে বলে।
ঠিক জমিয়ে রাখা নয়, অনেক বছর পরে আবার অন্য কোনো জীবনে ফিরিয়ে দেবার জন্য।
পূনর্দখলের এ লড়াই চিরদিনের।
দখল অন্য কিছুর না, শুধু ভালবাসার, আনন্দের
আর বেচে থাকার।
কথোপকথন
রুশা চৌধুরী।