Fatima Khan- Thoughts and Feelings

১.

সাপ্তাহিক বাজার করতে হাইপারপান্ডা যাই। পুরো সৌদি আরব জুড়ে অনেকগুলো ব্রাঞ্চ ওদের। এদের চেইনশপ গুলোতে প্রচুর বাংলাদেশী কাজ করে যাদের বেশীরভাগই শ্রমজীবী।

বাসার খুব কাছে আমি ওদের যে ব্রাঞ্চটা থেকে নিয়মিত বাজার করি, সেখানে এরকম একজন বাংলাদেশী ক্যাশ কাউন্টারে মালামাল প্যাকিং এর কাজ করত। আমি বাংলাদেশী জেনে আমার জিনিসপত্র গুলো প্রায়ই গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে যেত। প্রথমবার বকশিশ অফার করেছিলাম, বলেছিল ”দেশী বোনের থেকে কি বকশিশ নেওয়া যায় আপা, দোয়া কইরেন।”

নাম-গ্রাম কুশলাদি থেকে যেটুকু জানলাম, আঠার বছর বয়সে কাগজপত্রে বয়স বাড়িয়ে সে এদেশে এসেছিল। দেশে একসময় টানাটানির সংসার ছিল, এখন আল্লাহ তাকে সব দিয়েছেন, স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ সে।

মাস ছয়েক আগে  একদিন যখন বাজার করতে যাই তখন বলছিল “দেশে যাব আপা। ছেলেটার বয়স দুই বছর হইল এখনো দেখি নাই। দোয়া কইরেন। আপা, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি। কোম্পানি আমাদেরকে এগার পার্সেন্ট অফারের একটা কার্ড দিয়েছে। আপনি আরেকবার আসলে বেশি করে বাজার কইরেন, আমার কার্ড দিয়ে আপনারে ডিসকাউন্ট করে দিব। ” এই টুকু বলেই যেন সে খুব খুশী, হয়ত অনেক দিন পর দেশে যাবে, প্রথম সন্তানকে প্রথমবার দেখবে সেই আনন্দেই কিনা!

তার অফারটুকু গ্রহণ করি বা না করি, আমার ইতিবাচক জবাবে সে সম্মানিত বোধ করবে, এই ভেবে তাকে আশ্বস্ত করলাম।

এর মধ্যে অনেকদিন ওদিকে যাইনি। সেদিন বাজার করতে গিয়ে জানলাম তার আর দেশে যাওয়া হয়নি। বাচ্চাটার জন্য একটু একটু করে রাজ্যের জিনিসপাতি কিনেছিল। সবই ঠিকঠাক ছিল, যেদিন দেশে যাবে, তার আগের রাতে যে ঘুমিয়েছে আর জাগেনি। সন্তানের মুখটাও তার দেখা হল না!

২.

পঁচাশি বছরের এক চাচা মিয়ার গল্প বলি।

কাগজপত্রে বছর বিশেক কমিয়ে সৌদি আরব এসেছে। আমার সাথে যখন দেখা হয়, তখন তার চোখে ছানি পড়ে গেছে, দাঁত আর একটাও বাকি নাই। কানে ঠিকমত শোনে না। একপাটি দাঁত লাগাতে চায়, তাই আমার কাছে আসা। কোন ধনকুবের শেখ এর বাগানে মাত্র পাঁচশ রিয়াল মাইনেতে কাজ করে।

বললাম,

”চাচা আপনি এখনো বিদেশে আছেন কেন?”

“কি করাম! দ্যাশে কাম নাই। ছুটু মুটু কাম করলে মাইনষে চোহে দ্যাহে না, বিদ্যাশ রক্ত পানি করি, গান্দা কাম করি, ট্যাহা গুছায়ে গুছায়ে পাডাই, তয় দ্যাশে পরিবারের কাছে অনেক দাম। পুলাপাইন পড়াইছি। মাইয়া একটাই, বিয়া দিসি, জামাইরে পাচ লাখ ট্যাহা দিছি। সব কাম শ্যাষ অইছে। অহন আমার দাঁত নাই, খাইতে পারিনা। কষ্ট করসি য্যান পোলাপান বড় অয়।”

ওনার মত হাজার হাজার বৃদ্ধ পিতা এখনো বিদেশ বিভূঁই এ নিজে না খেয়ে, না পরে, চিকিৎসা না করিয়ে ‘পুলাপানডিরে’ মানুষ করার নিয়তে কেবল দিয়েই চলেছেন।

৩.

ছেলেকে নিয়ে সেদিন Nike র শোরুমে গিয়েছি। ওখানে দেখি আমাদের এলাকার এক পরিচ্ছন্নকর্মী তার ছেলের জন্য পুলওভার কিনতে এসেছে। বার কয়েক আমার ক্লিনিকে সে এসেছিল আগে, আর্থিক সমস্যার জন্য বহুদিন পেইনকিলার খেয়ে দিন কাটিয়েছিল ব্যাথার যন্ত্রণায়। শেষ পর্যন্ত তার চিকিৎসা করে দিয়েছিলাম বিনা পয়সায়। আমাকে দেখে বলল, ছেলে এস এস সি পরীক্ষা দেয়। Nike র পুলওভার আর iPhone চেয়েছে। আজই পাঠাবে। অনেকগুলো ভাংতি নোট দিয়ে পেমেন্ট করল যেন দিনের পর দিন কষ্টে ক্লিষ্টে জমানো ভাংতি নোট গুলো !  ছেলে পড়াশোনা করছে তাতেই সে ভারী খুশী।

এ মানুষগুলোর পরিবার আসলে তাদের ত্যাগ গুলো  বুঝতে পারে কিনা জানি না, তবে এটুকু বেশ বুঝে যে বিলাসিতার খোরাক যোগান দেবে এই মানুষটাই।

৪.

সেদিন ইমার্জেন্সিতে একজন বাংলাদেশী রোগী এসেছে সমস্ত শরীরে ব্যথা নিয়ে। পেশায় সে বাড়ির পাহারাদার। আগের রাতে তার স্পনসার তাকে বেদম মারপিট করেছে, বেচারার চলার শক্তিটুকুও নেই।। অপরাধ যাই হোক না কেন মারাধর করার অধিকার কারোর নেই। এরকম নির্দয়ভাবে মার খেয়ে, মলম মেখে, গা ঝাড়া দিয়ে যে মানুষটা আবার ঐ পিশাচটার চাকুরীই করছে, তার নিশ্চয়ই কোন বাধ্যবাধকতা আছে। 

কিন্তু তার পরিবার আদৌ ব্যাপারটা জানে বা বুঝে কি?

দেনার টাকা শোধ করতে না পেরে জেদ্দাতে এক সবজি ব্যবসায়ী আত্নহত্যা করেছে কিছুদিন আগে। হয়ত সে চায়নি  তার পরিবার বিষয়টা জানুক বা তার দেনার ভার বহন করুক।

সেদিন খবরে দেখলাম এখানে এক বাংলাদেশী মারা যাওয়ার পর পরিবার তার লাশ ফেরত নিতে চায়নি, শুধু কোম্পানি থেকে তার প্রাপ্য টাকাগুলো নিতে চেয়েছে!

সুযোগ পেলে এখানকার সাধারণ মানুষগুলোর খোঁজ  খবর নেই। এদের অনেকেই বিদেশ আসে দেশের ভিটেমাটি বিক্রি করে, কেউ আসে লাখ লাখ টাকা দেনা করে, কেউবা বউ এর গহনা বিক্রি করে। কিন্তু বিদেশ আসার পরও সুখের মুখ দেখেনা পারিবারিক অশান্তির কারণে। বিদেশে পা পড়ার সাথে সাথেই পরিজন বা স্বজনদের বায়না শুরু হয়ে যায়, একদিকে বউ এর অভিমান অন্যদিকে মায়ের অভিযোগ। সাথে আছে আত্নীয় স্বজনদের আবদার, মুখ ফোলানো।  আট দশ বছর দেশে না গিয়ে কতজন যে কত ঘামে ভেজা টাকা তিলে তিলে জমা করে বাড়িতে পাঠিয়েছে, তার কোন হিসেব নেই। আমার প্রাক্তন অফিসের বাংলাদেশি এক ড্রাইভারকে জানি যে দশ বছর দেশে যায়নি এই অভিমানে যে তার বাবা মা ভাইবোন কেউ নাকি একবারের জন্যও তাকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি, শুধু টাকাই চেয়ে এসেছে। মানুষগুলো খেয়ে না খেয়ে, যেন তেন কাজ করে কামাই করে, কাজের চাপে আর দুশ্চিন্তায় ডায়েবেটিস, হাইপারটেনশনে ভুগে। কাউকে কিছু না বলে বিনা চিকিৎসাতেই হয়ত একদিন হুট করে চলে যায়।

ঘটনাগুলো আমাদের কম বেশী সবারই জানা। তারপরও আমার লেখার উদ্দেশ্য হল আমাদের যাদের পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য বিদেশে আছেন, তারা যেন একটু সদয় হই। আমাদের অতিরিক্ত চাহিদাগুলো তাদের উপর চাপিয়ে না দেই। যিনি বিদেশে থাকেন তিনি কিন্তু আমাদের সুখের জন্যই নির্বাসিত জীবন বেছে নিয়েছেন। নিজের সর্বস্ব আমাদেরকেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন। পারিবারিক সমস্যা বা অভিযোগ গুলো বারবার তাদেরকে বলা হলে তাদের দুশ্চিন্তা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। তাদের কষ্টগুলো বরং আমরা শুনি, স্বান্তনা দেই। জীবন একটাই, ওদের দু:খগুলোকে প্রান্তিক না রেখে ভাগাভাগি করে নিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যায়?

About the Author:

Developer Herwill

Developer Herwill