… ২৯ তারিখ, আমার খুব প্রিয় একটা দিন! কারন স্যালারি বিল এদিন সাইন করি। তার দুদিন পর একাউন্টে এসে পড়ে এক মাস কষ্টের পর পাওয়া স্যালারি। এমন না যে টাকা পেলেই সব উড়াতে হবে। কিন্তু এই যে একটা স্বস্তিবোধ হয় মনে, যে আমার একটা সহায় আছে – সম্বল আছে – কাউকে না পুছে নিজের বুঝ মত নিজের টাকা খরচের একটা স্বাধীনতা আছে, এ আনন্দের সাথে পৃথিবীতে আর কিছুর তুলনা হয় না। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় পেশাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারলে, জীবন জীবিকা নিয়ে আর ভাবতে হবে না কখনই। আমার বাবা মা – সন্তান – সংসার সবার জন্য প্রয়োজন হলে আমিই একটা আশ্রয় হতে পারবো।
আমরা যখন মাত্র টিনেইজে, তখন প্রতিবেশী দেশে সুন্দরী প্রতিযোগিতার জয়জয়কার। মাল্টি ন্যাশনাল সৌন্দর্য সামগ্রী কোম্পানিগুলো সুযোগ বুঝে, সে সময়ে হানা দেয় এই উপমহাদেশে। আজকের আমি ডাক্তার, একজন কূটনীতিক, কিন্তু ঠিক সময়ে মাথা থেকে ওইসব ঝেটিয়ে বিদায় না করলে, আমিও পড়ালেখা করার বয়সে অমুক তমুক বিউটি প্যাজেন্টে অংশ নেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতাম!
কিংবা চাকরির পরীক্ষার পড়া পড়তে পড়তে যখন ক্লান্ত লাগতো, অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে সুখের সংসার করা বান্ধবীদের কথা ভাবতাম। আহা, কি নিষ্ঠুর স্বামী আমার। একবার বলেও না, পড়তে হবে না, তোমাকে আমি খাওয়াবো! আজকে এ পর্যায়ে এসে অনুভব করছি ভাগ্যিস এমনটা কেউ বলে নি! জীবনে কত বড় ভুল করতাম, যদি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য ছোটবেলা থেকে পরিশ্রম করতে আগ্রহী না হতাম।
আজকাল একটা স্লোগান, খুব ভাইরাল! “কামাই থাকলে জামাই লাগে না!”
খুব ক্লিশে আর ন্যারো লাগে শুনতে! কামাই আর জামাই কি একই জিনিস যে তুলনা করা যাবে?! আসলে স্লোগান ব্যাপারটাই তো এমন। অল্প শব্দে, ছন্দে ছন্দে বেশি কিছু প্রকাশ করা! নয়ত সঠিক বাক্যটা হত, “কামাই থাকলে জামাইয়ের মানিব্যাগ লাগে না!”
আমার ধারনা ছিল এই স্লোগান পুরুষ জাতির কাছেই বেশি ভালো লাগবে শুনতে। কারন সহস্র শতাব্দী ধরে তারা বলে আসছেন, বউ পালা আর হাতি পালা সমান! তো সেই ‘হাতি’টি যদি একদিন নিজের খরচ নিজেই ক্যারি করতে পারে, তাহলে তো সবচেয়ে আনন্দ তাদের পাবার কথা! কিন্তু না, এই স্লোগানে তারা ভীষণ ক্ষিপ্ত! এতে নাকি স্বয়ং স্বামীকেই তুচ্ছাতিতুচ্ছ করা হয়েছে! স্বামী কত জরুরি একটা জিনিস! সংসার দেয় – সন্তান দেয় – নিরাপত্তা দেয় – সহায় দেয়, এই রকম একটা মানুষকে কামাইএর সাথে বিনিময় করে ফেলার আস্পর্ধা তারা মানতেই পারছেন না! কিন্তু স্লোগানের অর্থ বুঝে যদি এই রাগ দেখাতেন, তাহলে আর বিতর্ক থাকতো না।
আমার ধারনা ছিল, সকল পিতা তার টিনএইজ কন্যাকে এই স্লোগান শেখাবেন। যেন সে পড়ায় মন দেয়। গলির মোড়ে যে ফালতু বখাটে মেয়েটার জন্য মিথ্যে ভালোবাসার কিছু কথা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে, যেন সে ছেলের দিকে মেয়েটা আর ফিরেও না তাকায়। ধারনা ছিল, সব ভাই তার বোনকে এই স্লোগান শেখাবে। যেন শ্বশুরবাড়িতে হাত পেতে পেতে পকেট মানি জমিয়ে বাবা মাকে টাকা না পাঠিয়ে, একদিন নিজের কামাই থেকেই বাবা মায়ের জন্য কিছু করতে পারে। আমার ধারনা ছিল সব স্বামী তার স্ত্রীকে এই স্লোগান শেখাবেন। যেন কোন দিন অসময়ের তার মৃত্যু হলে বা দেউলিয়া হতে হলে, স্বনির্ভর স্ত্রী তার সন্তানদের দেখে রাখতে পারেন।
নাহ, হলই না এমন। হল পুরো উলটা! কারো বাবা, কারো ভাই, কারো স্বামী হয়ে থাকা পুরুষেরাই এই স্লোগানের প্রধানতম সমালোচক! শিক্ষিত অশিক্ষিত বাছ বিচার নাই! শতে ৯৫ জন!
আসলে একটা মেয়ে, অল্প শিক্ষিত – সুশিক্ষিত – উচ্চ শিক্ষিত, যাই হোক, তার সামনে জীবন নিয়ে দুইটা পথ খোলা থাকে। হয় কামাই ওয়ালা জামাই। বা আমাদের পথ, যেটা বাবার স্বপ্ন – মায়ের আকাঙ্ক্ষায় গড়ে উঠে। মেধার পথ, অনেক কষ্ট, অনেক। স্বাবলম্বী হলেও দায়দায়িত্ব সবই দ্বিগুন পালন করতে হয় ঘরে বাইরে। কিচেনেও যেতে হয়, বাচ্চাও পালতে হয়। এরপরেও হুজুর বলেন, আমরা জাহান্নামের লাকড়ি! পুঁজিবাদের দাসি। ঘরের রাজ্যপাট – সন্তান পালন- শ্বশুরবাড়ির খেদমত বাদ দিয়ে অফিস করতে যাই, উদ্যোক্তা হই।
আচ্ছা, আমাদের সমাজে এত জনপ্রিয় বিশিষ্ট আলেম আছেন, ধর্মিয় স্কলার আছেন, সবাই পুরুষ কেন? মিডিয়াতে যাদের দেখা যায়, যারা রাজনৈতিক মাঠেও পরিচিত তারা যখন মঞ্চে বসেন, তাদের পাশে উপযুক্ত পর্দা করে একজন মেধাবী নারী আলেম বসতে পারেন না? আমরা তো জাহান্নামের লাকড়ি হলাম, যারা জান্নাতের আগরবাতি হয়ে জীবন কাটাতে চায়, তারা কোথা থেকে আদর্শ খুঁজে পাবে নয়ত? দুই একজন নারী স্কলারকে সামনে রাখা হলেই তো তারা জানতো, তাদের ভবিষ্যৎ শুধুই কিচেনে বা স্বামীর মানিব্যাগে নয়।
বিবি খাদিজা (রা) পর্দা রক্ষা করে বিশাল ব্যবসা করতেন, সেই ১৪০০ বছরের আগের কিংবদন্তি শুনে তো এ কলিযুগের প্রজন্ম কনভিন্সড হবে না। আমাদের রক্ষণশীল সমাজ যেমন সুশীল হয়ে থাকতে চায়, সেটা এই মুক্ত সংস্কৃতির যুগে তো অসম্ভব, যদি সে রকম আইডল না রাখা হয় সামনে।
সামনে কেবল সাজগোজের আয়না, রান্নাঘর, ধর্মকর্ম, আর স্বামী-নির্ভরশীলতাই যদি রাখা হয়, তাহলে সমাজ তো এভাবেই চলবে, যেভাবে চলছে বলে আমরা সবাই জাত গেলো! জাত গেলো!! বলে মাতম করছি। স্বামীর মানিব্যাগই যদি কোন তরুণীর ভবিষ্যৎ হয়, তাহলে তো তার মাল্টি বিলিওনিয়ার মানিব্যাগ চয়েজ করাই ভালো!
একটা টিনেইজ মেয়ের চোখের সামনে বর্তমানের কোন ধার্মিক নারী আদর্শও নেই, আবার আমাদের মত ২৯ তারিখে বেতন বিল সাইন করা অফিসার বা নারী বুদ্ধিজীবী বা নারী উদ্যোক্তা বা ‘কামাই থাকলে জামাই লাগে না’ পন্থীদেরও কোন সম্মান নেই। তো সে করবেটা কি, যা করেছে সেটা করা ছাড়া?!
খুব সহজেই তো আমরা নতুন প্রজন্মকে জাজ করে ফেলি। কিন্তু সবদিক থেকেই তো তারা সাফারার। যে আদর্শহীন সমাজ আমরা গড়ে তুলছি, সেটার সাফারার।