আমি আমার শৈশবের হারিকেনের যুগটাকে খুব মিস করি। হয়তো আমার মতো অনেকেই মিস করেন।
আমি অবসরে বসে আমার হারানো দিনের কথা ভাবছি। বোনের ছেলে এসে বলে, “আমাকে একটা ড্রয়িং এঁকে দাও তো।”
আমি কি আঁকবো ভাবতে ভাবতে, অজান্তেই আমার মিস করা বেকা-তেড়া একটা হারিকেন আঁকলাম।
ছেলে তো অবাক, “ওমা, খালামনি একি আঁকলা, এটা কি জিনিস!”
আমি বললাম, “এটার নাম হারিকেন, আমাদের যুগে ইলেক্ট্রিকের বাতির বিকল্প বাতি।
আমাদের ছোটবেলায় ইলেকট্রিক চলে গেলে, আমরা ভাই-বোনেরা এই হারিকেন নিয়ে পড়তে বসতাম।
ছেলে চোখ কপালে তুলে বলে, “কেন, তোমাদের কি আই.পি.এস, জেনারেটর, চার্জার লাইট, মোবাইলের লাইট এসব ছিলো না?”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম, “নারে বাচ্চা, আমাদের যুগে তোদের মতো, আই.পি.এস, জেনারেটর, চার্জার লাইট, মোবাইলের লাইট এসব কিছুই ছিলো না।
তবুও আমাদের যুগটা কি সুন্দর ছিলো, কি আনন্দের ছিলো!
চোখের সামনে ভাসছে, মা প্রতিদিন সন্ধ্যায় হারিকেনে তেল ভরে, কাঁচের চিমনি মুছে ঝকঝকে করে রাখতেন।
ইলেক্ট্রিক চললে গেলে জালাতেন, আমাদের বাসায় তিনটা হারিকেন ছিলো।
ইলেকট্রিক চলে গেলেই একটা হারিকেন জালিয়ে ভাই-বোনেরা পড়তে বসতাম। একটা হারিকেন জালিয়ে মা রান্না ঘরে রান্না করতেন। একটা হারিকেন এমন ভাবে রাখা হতো, যেন সব রুমে আলো থাকে।
পড়তে বসা হারিকেন দিয়ে পড়া হতো কম, দুষ্টামি হতো বেশি। কাঠ পেন্সিলের রাবার চিমনিতে ঘষা দিয়ে রাবার গলানো হতো। হারিকেনের উপরে একটু করে পানির ছিটা দেয়ার ছ্যাত ছ্যাত আওয়াজ শুনে খুব আনন্দ পেতাম। অবশ্য এই আওয়াজ মায়ের কানে গেলে খবর হতো, রান্নার কাঠি দিয়ে আমাদের পিঠে শুধু ঠাস-ঠাস আওয়াজ হতো।
“ছ্যাত-ছ্যাত এর পর ঠাস-ঠাস আওয়াজ, কি সুন্দর মিউজিক!”
এই মিউজিক বাজার কারণ হলো, তাতানো চিমনিতে পানি পড়লে চিমনি ফাটার সম্ভাবনা থাকতো।
হারিকেনের আলোতে অনেক পোঁকা ও মশা উড়ে আসতো, ওগুলোকে মেরে হারিকেনের উপর ছেড়ে দিয়ে ফ্রাই হওয়া দেখতাম।
এই পৈশাচিক আনন্দ মনে হয় সব যুগের বাচ্চাদের মধ্যেই আছে। আমরা হারিকেনে পোঁকা-মশা ফ্রাই করে আনন্দ পেতাম, এখনের বাচ্চারা বিভিন্ন গেমসের দুষ্ট ক্যারেক্টার মেরে আনন্দ পায়!
অনেক সময় হারিকেনের ভলিউম উঠানামা করতে গিয়ে আগুনের সলতে ভিতরে ফেলে দিতাম।
হারিকেন নিভে যেতো, মা এসে রান্নার কাঠির ঠাস-ঠাস মিউজিক বাঁজাতেন।
প্রচন্ড গরমে উঠোনে পাটি বিছিয়ে হারিকেন নিয়ে পড়তে বসতাম। একবার উঠোনে পড়তে বসলে, পড়া কি আর হতো।
চাঁদের দিকে তাকিয়ে চরকা সহ চাঁদের বুড়িকে খোঁজতাম, আকাশের তাঁরা গুনতাম, তাল গাছের নঁড়ে উঠা পাতাকে, পেত্নী ভেবে ভয় পেয়ে ভাই-বোনের পাশে ঘেষ বসতাম।
মায়ের মুড ভালো থাকলে, রান্না শেষে মা আমাদের সাথে পাটিতে বসে তালপাখা দিয়ে বাতাস করে রুপকথার গল্প শুনাতে।
এখনের প্রজন্ম নেটওয়ার্ক, ওয়াইফাই, ইউটিউব, কার্টুন, পাবজি গেম, ফ্রি-ফায়ার গেমস, আরও কতো কি নিয়ে ব্যাস্ত থাকে।
আহারে, উন্নত প্রযুক্তি আমাদের সেই সোনালী যুগটাকে কেড়ে নিলো। কোথায় গেলো মায়ের হাতে চিমনি পরিষ্কার করা হেরিকেনের যুগ।
উঠোনে মাদুর পেতে মায়ের কোলে মাথা রেখে, তালপাখার বাতাস খেয়ে রাক্ষস-খোক্কসের গল্প শুনার যুগ। চরকা সহ চাঁদের বুড়িকে খোঁজা, আকাশের তারা গুনার যুগ!
খুব মিস করি আমার সেই শৈশব, সেই সোনালী শৈশব!