Rayna’s Homecoming – Pohela Baisakh

রায়না এখন আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছে। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আসতে প্লেনে করে প্রায় আট ঘন্টা আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিতে হয়, চারিদিকে শুধু পানি আর পানি..!

 পৃথিবীতে যে এতো পানি আট ঘন্টা আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি না দিলে রায়না জানতোই না।

সেদিন সে খবরে দেখেছে ‘ইউ এস বাংলা’ নামে একটা বাংলাদেশী প্লেন নেপালে ক্রেশ করেছে।

 ভিতরের মানুষগুলি পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে, অনেককে তো ডি.এন.এ টেস্ট করে লাশ শনাক্ত করতে হয়েছে। ছোট্ট প্রিয়ন্ময়ীর ছোট্ট কফিনটা রায়নাকে আজো কাঁদায়……..

রায়না ভাবছে, “আজ যদি তাদের প্লেন ক্রেশ করে, তাহলে সবাই মিলে সাগরে তলিয়ে যাবে।

 দেশে পাঠানোর জন্য তাদের লাশের অস্তিত্ব ও কেউ খুজে পাবে না।

রায়না সাত বছর পর আমেরিকা থেকে স্বামী আর দুই মেয়ে রিয়া রাইসাকে নিয়ে দেশে আসছে বেড়াতে।

 দেশ থেকে যাওয়ার সময় রিয়া তিন বছরের ছিলো,  এখন রিয়ার বয়স দশ বছর। রাইসা আমেরিকাতে জন্ম, রাইসার বয়স পাঁচ বছর। তারা দু’মাসের ছুটি কাটাতে আসছে।

 রায়না সাত বছর আমেরিকায় ছিলো ঠিকই, কিন্তু তার মন পড়ে ছিলো দেশে….।

রায়নার স্বামী ব্যাংকার ছিলেন, হঠাৎ ডি.ভি লটারিতে আমেরিকায় চলে গেলেন।

রায়না তার নিজের দেশ, নিজের পরিবার ছেড়ে যেতে চায়নি, কিন্তু তার স্বামীর স্বপ্ন। স্বপ্নের দেশে যাওয়া, হায়রে স্বপ্নের দেশ..!!

মরে গেলেও নিজের দেশের মানুষ দেখা যায় না, বাংলা কথা শুনা যায় না। নিজের দেশের খাবার শুটকি ভর্তা, ছোট মাছ চোখেও দেখে না, কিছু খেতে গেলে ভয় লাগে, হালাল খাবার তো!

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেশিনের মতো সব কাজ নিজ হাতে করতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠে।

নিজের গাড়ি নিজে ড্রাইভ করতে হয়, একটু অসচেতনভাবে গাড়ী চালালেই বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটে যায়।

অচেনা দেশের স্কুল বাসে মেয়েকে তুলে দিতে হয়, যতক্ষন মেয়ে না আসে ভয়ে বুকটা মোচড় দিয়ে থাকে। কিছু কিনতে গেলে অনর্গল ইংরাজি বলতে না পারলে লজ্জিত হতে হয়।

ঈদের দিন কেউ আসে না কারো বাসায়, একা একা ঘরে বসে ঈদ করে।

নিজের দেশের ঈদের কথা মনে পরে, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে গোসল করে নতুন জামা কাপড় পড়ে, সবাইকে সালাম করা। দেশের নববর্ষের কথা মনে পড়ে।

অমেরিকায় অসুস্থ হলেও কেউ কাউকে দেখতে যায় না, সেই সময় কোথায়??

সবাই যার যার যান্ত্রিক জীবনে ব্যাস্ত।

রায়না নিজের দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠান খুব মিস করে। মাঝেমাঝে সে একা বসে বসে কাঁদে আর ভাবে, আমেরিকায় এসে সব কিছু বদলে গেছে বদলায়নি তার চোখের জল। আগে যেমন কষ্ট পেলে চোখ গঁড়িয়ে পড়তো, এখনো কষ্টে চোখ গঁড়িয়ে পড়ে।

রায়নার বুক চিরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এলো…।

কতদিন বাবা-মা, ভাই-বোনকে দেখে না। কতদিন দেশের মাটির গন্ধ, দেশের বৃষ্টি, দেশের আকাশের চাঁদ!!!

কতদিন সে এসব থেকে বঞ্চিত….!

দেশের চাঁদ তো আর নেয়া যাবে না, এবার যাওয়ার সময় দেশের একমুঠো মাটি নিয়ে যাবো, দেশের জন্য মন খারাপ লাগলে দেশের মাটি ছুয়ে দেখবে।

মনে হচ্ছে কতদিন পেট ভরে ভাত খায়নি, বাড়ী গিয়ে মায়ের হাতের শুটকির ভর্তা দিয়ে পেট ভরে ভাত খাবে।

সবাই ভাবে আমেরিকা স্বপ্নের দেশ।

 নিজের দেশ, দেশের ফেস্টিভ্যাল ছেড়ে যে থাকে সে জানে ভিনদেশ কতটুকু স্বপ্নের….!

রায়না প্লেনে বসে নস্টালজিয়ায় পড়ে গেছে, আজ এপ্রিলের বারো তারিখ।

চৌদ্দ তারিখ পহেলা বৈশাখ, এবার সে মেয়েদের নিয়ে পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে যাবে, মেয়েদের নিয়ে বৈশাখী মেলায় যাবে।

আহা কতদিন পরে শুনবে সেই চেনা সুর, “এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।”

তার মেয়েরা কখনো এসব বাঙালি ফেস্টিভ্যাল দেখেনি, তাদের লাল পাড়ের সাদা শাড়ী আর লাল চুড়িও কিনে দিবে।

আচ্ছা, তার মেয়েরা কি জিন্স-টপস ছেড়ে শাড়ি-চুড়ি পরবে??

রায়নার মনে পড়ে যায় ছোট বেলার নববর্ষের কথা।

বাবার হাত ধরে রমনা বটমূলে যাওয়া, পানতা ইলিশ খাওয়া, তারপর মেলায় গিয়ে নাগরদোলায় চড়া।

আর নাগরদোলা নিচে নামার সময় শক্ত হাতে বাবাকে ধরে রাখা।

চুড়ির দোকানের সামনে এসে বায়না ধরা, দু’হাতে যতক্ষণ জায়গা নিবে ততক্ষণ লাল চুড়ি পড়বে।

 বাসায় গেলে মা ধমক দিয়ে বলতেন,”এসেছে বেদের মেয়ে জোসনা।”

একথায় রায়না খুব অপমান বোধ করতো, ভে ভে করে কেঁদে দিতো। বাবা কোলে নিয়ে আদর করে কান্না থামাতেন, আর মাকে কৃত্তিম ধমক দিয়ে দিতেন।

এসব কথা মনে করে রায়না অজান্তেই হেসে উঠলো।

প্লেনে বসে বসে রায়নার বিরক্তি ধরে যায়, কখন নিজের দেশটা দেখবে…..?

আচ্ছা সাত বছর আগে ছেড়ে যাওয়া দেশটা কি আগে যেমন ছিলো এখনো তেমনি আছে? সেই মানুষ, সেই মাটি, সেই বৈশাখের আমেজ..!!!!

রায়না তার গালে গরম কিছু অনুভব করে, হাত দিয়ে দেখে তার চোখের পানি গঁড়িয়ে পড়ছে।

তার এই চোখের পানি আনন্দের, নিজের দেশে ফেরার আনন্দ, ফেলে যাওয়া প্রিয়জনদের দেখার আনন্দ, বাংলা নববর্ষ পালন করতে পারার আনন্দ।

এই আনন্দ যেন সীমাহীন, এই আনন্দ যেন আজ সবকিছুকে ছাঁড়িয়ে যাচ্ছে……

“এ বুঝি বৈশাখ এলেই শুনি, মেলায় যাইরে…….।”

About the Author:

Developer Herwill

Developer Herwill